নিজস্ব প্রতিবেদক :-
বাংলাদেশে আমাদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত,বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, রয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রশস্ত একাধিক
নদী পাহাড় ও সবুজ বনানী। পর্যটন শিল্প বিপ্লবের এত অফার সম্ভাবনা থাকলেও এখাতটি সামনে এগুতে পারছে না। গুরুত্বপূর্ণ এখাত থেকে সরকারের বিপুল অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বারবারই তা
উপেক্ষিত হচ্ছে। অপরদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এখাতে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সার্বিক সহযোগিতা পেলে পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে। এই খাতের অপার সম্ভাবনা গুলোকে সঠিকভাবে শতভাগ কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ট্যুরিজম এশিয়ান ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডস ( এসএটিএ ) ২০২৪ খ্রিঃএ ভূষিত ভোলার মনপুরার কৃতি সন্তান,পর্যটন শিল্পের গবেষক,বিশ্লেষক ও ইউনিক হোটেল এন্ড রিসোর্টস পিএলসি এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাখাওয়াত হোসেন।
এক সাক্ষাতকারে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের অসংখ্য ইউনিক ট্যুরিস্ট লোকেশন রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কাছে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। সারা বিশ্ব থেকে আমাদের দেশে যেখানে পর্যটকদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা, সেখানে আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা কেবল ব্র্যান্ডিং-এ জোর দিচ্ছি। অথচ পর্যটকরা কীভাবে যাতায়াত করবে, থাকবে কোথায়, তাদের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নত করার দিকে নজর কম। অতীতে পর্যটন মন্ত্রণালয়, করপোরেশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোয় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট কিংবা অভিজ্ঞ ছিলেন না। এর ফলে এ খাত এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সম্ভাবনা থাকলেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। তাই কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।
পর্যটন খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাত ও উদ্যোক্তাদের সেভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি উল্লেখ করে মো: শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বেসরকারি উদ্যো ক্তাদের লাইসেন্সিং, লজিস্টিকস, আর্থিক সহযোগিতাসহ যেসব সাপোর্ট সরকারের দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হচ্ছে না। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহা. নূর আলী পাঁচতারকা মানের ওয়েস্টিন হোটেল চালু করেন। তার দেখাদেখি পরে অন্যান্য বেসরকারি উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় এবং সরকারের সহযোগিতা সেভাবে না থাকায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা এখন পুনর্বিনিয়োগ করবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত।
শাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, আমাদের লাইসেন্সের জন্য ২২ প্রতিষ্ঠানে ঘুরতে হয়। এটার বদলে একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হওয়া দরকার। এ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ, ট্যাক্স হলিডে ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অসংখ্য দক্ষ জনবল কর্মহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
যোগাযোগের এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছুটা উন্নতি সাধন হলেও পর্যটনে বাংলাদেশ এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসির এ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সরকারের উচিত বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা। সে জন্য তাদের যা যা প্রয়োজন, সেগুলো সহজতর করতে হবে। অপরদিকে পর্যটন খাতে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যগুলোর যদি দেশে উৎপাদন বাড়ানো যায় কিংবা আমদানিতে আরও সুবিধা দেওয়া যায়, তাহলে তা এ খাতের বিকাশকে আরও বেগবান করবে। পাশাপাশি ‘ফুড ডিপ্লোমেসি’র দিকেও নজর দিতে হবে। বিশ্বে ইন্ডিয়ান, থাই, চাইনিজ খাবারের যেমন আলাদা পরিচিতি রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশি খাবারেও আলাদা পরিচিতি ও ব্র্যান্ডিং তৈরি করতে হবে।
দেশেই এখন এ খাতের প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যটনবিষয়ক শিক্ষা রয়েছে। এ বিষয়ে পড়াশোনা করলে কাজের অনেক সুযোগ। প্রতি বছর অনেক মেধাবী এ সেক্টরে যোগ দিচ্ছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসি নতুনদের সুযোগ করে দিচ্ছে। সুতরাং এ খাতে দক্ষ জনবল আছে। কিন্তু তাদের শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে তাদের অনেকেই বিদেশমুখী হচ্ছেন। তাই কর্মসংস্থান তৈরিতে পর্যটন খাতকে আরও উন্নত করতে হবে। এর জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তাদের ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
মো: শাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকার ঠিক করেছিল ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে ৫০ লাখ পর্যটক আনবে। কিন্তু আমরা বলছি যথাযথ উদ্যোগ থাকলে এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন সম্ভব। বর্তমানে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪ দশমিক ২ শতাংশ মাত্র। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে কীভাবে ডাবল ডিজিটে নেওয়া যায়। আমাদের সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দক্ষিন বাংলার পর্যটন পিপাষুরা বলেন,
ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপকন্ঠে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে উঠা চর কুকরি-মুকরিতেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বন্যপ্রানীর অভায়ারন্য। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস স্বপ্নের দ্বীপ কুকরি-মুকরিকে সাজিয়েছে সাজের সমারোহে। চিত্রা হরিন, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু বন বিড়াল, ইত্যাদি, আর পাখি ও সরিসৃপ হিসাবে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোড়গ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ুর , কোয়েল, গুইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ইত্যাদি প্রানী চর কুকরি-মুকরির বনে দেখা যায়। কুকরি-মুকরির প্রধান আকর্ষন সাগর পাড়, এখানে উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা সমুদ্র সৈকতের কথা, এছাড়া ও এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমন পিপাসুদের মুগ্ধ করবে।
ইতোমধ্যেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, ক্যাম্পিং করার জন্য প্রশস্ত বিচ আর নিরব শান্ত পরিবেশের জন্য পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এটি। পাশেই আছে মনপুরা। ঘন বন, লোকালয়ের কোলাহল থেকে দূরে, নানা বণ্যপ্রাণির অবাধ বিচরণের মাঝে প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য পেতে প্রায়ই এখনে ভ্রমণ করেন অসংখ্য মানুষ।
এপ্রসঙ্গে মোঃ শাখাওয়াত হোসেন বিশেষ করে ভোলার চরকুকরী মুকরী নিয়ে বলেন, এই জায়গাটা খুবই সুন্দর, প্রশস্ত বিচ, বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি দেখতে খুব ভালো লাগছে, তবে, এখানে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা খুবই খারাপ, একটি ভালো যাতায়াত ও পর্যাপ্ত সবধরনের মানসম্মত থাকা,খাওয়া, ভ্রমন ব্যাবস্থা থাকলে পর্যটকদের এখানে আসার আগ্রহ ও বিভিন্ন এলাকার সাথে যোগাযোগ বেড়ে যেতো।
ভোলা জেলার সর্বদক্ষিণের দ্বীপের নাম ঢালচর। দেশের বৃহত্তম দুটি সমুদ্র সৈকতের পরে ঢালচর দ্বীপের তারুয়া এলাকাটি তৃতীয় সমুদ্র সৈকত হিসেবে স্থান পেতে পারে বলে জানিয়েছেন ভ্রমণকারীরা।
ভ্রমনকারীরা বলেন, তারুয়ার পুরো দ্বীপটি দেখার স্বাদ যেন অপূর্ণ-ই রয়ে যায় কারো কারো। যে প্রান্তেই চোখ যায় সেদিকেই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য। দ্বীপজেলায় এমন প্রকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি রয়েছে তা স্ব-চক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেনা।
ভোলা থেকে প্রায় ৮০ কিঃ মিঃ দুরত্বে সাগরের বুকে নয়নাভিরাম আরেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ প্রাকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা।
১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষের বনায়ন শুরু হয়। চর কুকরি মুকরির বনভূমিতে স্থান পেয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া, নারিকেল, বাঁশ ও বেত।
বর্তমানে কুকুরি মুকুরি চরে বনভূমির পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে ২১৭ হেক্টর জমি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। বসতি ও কৃষি আবাদের জন্য প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাছ ধরা ও কৃষিকাজ চর কুকরি মুকরিতে বসবাসকারী মানুষের প্রধান পেশা।
বণ্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য চরকুকরী মুকরীতে শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সূদুর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরিমুকরি এর চর অতিথি পাখিদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের অন্যান্য বড় পর্যটনস্পটের পাশাপাশি ভোলা জেলার পর্যটন স্পটগুলোর ন্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত রয়েছে। এই খাতগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সহায়ক হয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আশা করছি। যেহেতু সরকারের একার সামর্থ্য দিয়ে অতীতে তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি তাই পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বেসরকারি বিনিয়োগকে আরো উৎসাহ দিতে হবে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছি।একাধিক জাতীয়ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি।
তাই আমি আমার টিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশে আমাদের সকল অংশীজন, স্টেক হোল্ডার এবং ট্যুরিজম শিল্পের সমর্থনের প্রশংসা করছি ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। এশিয়ান হসপিটালিটি এন্ড ট্যুরিজম মার্কেটে আমি আমাদের দেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে আরো এগিয়ে নিতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
You cannot copy content of this page