নদীতে ইলিশের পরিমান বাড়লেও বাজার মূল্য ক্রেতাদের নাগালের বাহিরে

এইচ এম জাকির:

ইলিশের ভরা মৌসুমেও দীর্ঘ কয়েক মাস ভোলার মেঘনা-তেতুলিয়া নদীতে ইলিশের দেখা না মেললেও সপ্তাহ খানেক ধরে জেলেদের জালে দেখা মিলছে ঝাকে ঝাকে ইলিশ। তাই বুক ভড়া হাসি আর আনন্দ নিয়ে প্রতিদিন ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে জাল সাবার নিয়ে উত্তাল মেঘনার বুকে পাড়ি জমাচ্ছে জেলেরা। রূপালী ইলিশ ধরার আমেজে কোন বাধাই যেন তাদের পিছু হটাতে পারছে না। তবে ইলিশের পরিমান বৃদ্ধি পেলেও বাজার মুল্য বৃদ্ধি হওয়ায় ইলিশ ক্রয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা।

গেল মার্চ এপ্রিল অভিযানের দু-মাস শেষ হতেই নদীতে দেখা দিয়েছে ইলিশ শুণ্যতা। জেলেরা জাল সাভার নিয়ে দিনভর নদীতে থেকে মাছ পেয়েছে ২/৪ হালি। অধিকাংশ সময়ই নদী থেকে জেলেদেরকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। পরিবারের আহারের মাছটুকুও জোগান দিতে তাদেরকে হীমসীম খেতে হয়েছে। এমতবস্থায় উপার্জনের উপায় খুজে না পেয়ে বহু জেলেই জাল সাভার তুলে মাছ ধরার পেশা ছেড়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়।

জেলেদের মতো মৎস্য ব্যবসায়ীরাও পরেছেন চরম বিপাকে। মোটা অকেংর টাকা দাদন দিয়ে প্রতিটি মূহুর্ত যেন কেটেছে তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। কখন নদীতে দেখা মিলবে রূপালী ইলিশ। কখনইবা ট্রলার বোঝাই ইলিশ নিয়ে ঘরে ফিরবে জেলেরা। দাদনের টাকা ফিরে আসবে এমন প্রতিক্ষায়ই এক একটি দিন পার করেছিলেন তারা।

এদিকে গেলো কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথেই দেখা দিয়েছে ইলিশের সমারোহ। কোন জেলেকেই নদী থেকে এখন আর খালি হাতে ফিরতে হয়না। প্রত্যেক জেলের জালে ধরা পড়ছে ঝাকে ঝাকে ইলিশ। হাক-ডাকে মূখরিত প্রতিটি মাছ ঘাট। উৎসবে মেতেছে জেলে পল্লীগুলো।

সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘ দিন পর জেলার প্রতিটি মাছঘাট গুলোতেই ফিরে পেয়েছে প্রাণ চাঞ্চল্য। ছোট-বড় মিলিয়ে জেলার প্রায় ২ শাতাধিক মাছঘাট গুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার উপচে পড়া ভীর। এসব আড়ত থেকে ইলিশ মাছ জেলার বিভিন্ন বাজারের পাশাপাশি বরিশাল, চাঁদপুর, ঢাকা, খুলনা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে মাছ ধরে জেলেরা ঘাটে এসে মাছ বিক্রি করেই আবার ফিরে যাচ্ছেন নদীতে। কে কত বেশি মাছ আহরণ করতে পারে এ নিয়ে চলছে যেন জেলেদের মাঝে প্রতিযোগিতা। জেলেরা বলছেন, অনেক দিন পর হলেও এখন নদীতে ইলিশের পরিমান অনেকটা বেড়েছে। দৌলতখানের বটতলা মাছ ঘাট এলাকার শিহাব মাঝি, সাইফুদ্দিন মাঝি, সিরাজুল, মাইনুদ্দিনসহ বেশ কয়েক জন জেলের সাথে কথা হলে তারা জানান, এতোদিন দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে ইলিশের দেখা মিললেও এই অঞ্চলের মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীতে তেমন ইলিশের দেখা মিলেনি। টানা ৪/৫ মাস নদীতে আশানোরূপ ইলিশ না পাওয়ায় প্রতিটি জেলে পরিবার গুলোর জীবন কেটেছে অর্ধাহারে অনাহারে। এখন সপ্তাহ ধরে নদীতে ইলিশের পরিমান অনেকটা বেড়ে গেছে। এখন কোন জেলেরকে খালি হাতে নদী থেকে ফিরতে হয় না।

পাশেই রয়েছে পাতারখাল এলাকার মাছঘাট। সেখানেই একাদিক জেলের সাথে কথা হলে তারাও মনের আনন্দে নদীতে ইলিশের পরিমান বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এখন জাল ফেললেই দেখা মিলে ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির ইলিশ। এখন ছোট একটা নৌকায়ও ৪/৫ হাজার টাকার ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছে।

এর সাথে বাজার মূল্যও ভালো হওয়ায় মাছ বিক্রি করে মাঝি মাল্লা ও তেলের খরচ পুষিয়ে আনেকটা লাভের মূখ দেখছে এমনটি দাবী করে অধিকাংশ জেলেরা। দীর্ঘ দিন যাবত দারদেনায় জর্জরিত হয়ে অনেকটা বেকার জীবন যাপন করে একই এলাকার হোসেন মাঝি বলেন, কয়েক মাস মাছে অবস্থা খারাপ দেখে বহু দোকানে দেনা হয়ে মাছ ধরার পেশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছি। কয়েক যাবত নদীতে ইলিশের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় মনের আনন্দে আবার জাল সাভার নিয়ে মনের আনন্দে ইলিশ আহরনে নদীতে নেমে পড়েছি। মনে হয় অনেকদিন পর আল্লাহপাক আমাদের দিকে তাকিয়েছেন।


জেলেদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফিরে এসেছে অনাবিল হাসি আনন্দ। তবে গত বছরের তুলনায় চলতি ভরা মৌসুমে ইলিশের পরিমান অনেকটা কম দাবী করছেন তারা। ইলিশের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ভোলার ঢালচর ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী কালাম পাটওয়ারী বলেন, গেলো বছরও দাদনের বেশ কিছু টাকা জেলেদের কাছ থেকে এখনো আদায় করতে পারিনি। এখন দেখা যাক চলতি মৌসুমের অনেক দিনতো পার হয়ে গেলো এখন যে পরিমান ইলিশ পাওয়া যায় এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তোবা পিছনের লোকসান গুলোও অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবো।

ব্যবসায়ী লোকমান মহাজন বলেন, গত বছর এই সময়টিতে মোকামে প্রায় ৩০/৪০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছি। এ বছর তার অর্ধেকও এখনো করতে পারিনি। তবে আশায় আছি এখন একট্ ুইলিশের দেখা মিলছে সামানের দিকে কি হয় সেটা দেখারই অপেক্ষায়।

অপর দিকে মনপুরার হাজির হাট এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মোশারেফ হোসেন বলেন, দীর্ঘ দিন অপেক্ষায় থেকে এখন কিছুটা ইলিশের দেখা পাই। তবে গত বছরের তুলনায় অনেক কম। আল্লাহ যদি দেয় হয়তোবা সামনের দিন গুলোতে ইলিশের পরিমান আরো বাড়বে বলে মনে করছি।
এদিকে নদীতে ইলিশের পরিমান বাড়লেও দাম নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। যেখানে সহজমূল্যে ক্রেতাদের কাছে ইলিশ চলে যাওয়ার কথা, সেখানে এতো ইলিশ পাওয়া সত্বেও চওড়া মূলে ক্রয় করতে হয় এ মাছ। অধিকাংশ ঘাটেই দেখা গেছে ৩শ’ থেকে ৫শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ হালি প্রতি (৪টি) বিক্রি হচ্ছে ১৫শ থেকে দুই হাজার হাজার টাকা, ৬শ’ থেকে ৮শ’ গ্রামের হালি ২৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা। তাছাড়া কেজির উপরের ইলিশের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ হাজার টাকা। অনেক দিন পর হলেও ইলিশের পরিমান অনেকটা বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় দাম তেমন কমেনি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। সামনের দিনগুলোতে কিছুটা দাম কমতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

তবে ভরা মৌসুমেও নদীতে ইলিশের পরিমান কিছুটা কম হওয়ার পিছনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবকেই দাবী করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, এতোদিনে নদীতে ইলিশের পরিমান কিছুটা কম থাকলেও সাগরে কিন্তু জেলেদের জালে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়েছে। এখন ্আবার নদীতে পানির পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ার সাথেই বেড়ে গেছে ইলিশের পরিমান। সামনের দিন গুলোতে এ মাছের পরিমান আরো বড়বে বলে আমরা আশা করছি। কখন দেখা যাবে বাজার মূল্যের দিক থেকেও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে ইলিশ।